বাক্‌ ১৩২ ।। কবিতা সংখ্যা





অনুপম বলছি
বিপজ্জনক অথচ হাস্যোজ্জ্বল ঘটনা ঘটে, যখন একজন লেখক আরেকজনের লেখা সম্পর্কে বলেন সেই লেখা তিনি অক্লেশে লিখে ফেলতে পারেন। এটা একজন কখন বলতে পারেন? তখন, যখন তিনি একটা লেখার জন্ম ও মৃত্যু বিষয়ে উদাসীন থাকেন, এবং নিজের লেখক পরিচয়ের প্রতি থাকেন অজ্ঞ। একটা লেখা হয়ে যাওয়ার পরে সেই লেখা স্বয়ং লেখকও আর লিখতে পারেন না, অনুলিপি করতে পারেন মাত্র। আরেকজন সেটা কী করে লিখবেন? সম্ভবত তিনি বলতে চান ওই সামান্য গুণমানের লেখা লিখে ফেলতে তাঁর আধঘন্টা সময় যাবে। সেটা হতেই পারে। একটা মিনি তাজমহল আপনি উপহার সামগ্রীর দোকানেই কিনে ফেলতে পারবেন। বিষ্ণুপুরে দেখবেন অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলমাদল কামান বিক্রি করা হচ্ছে পোড়ামাটিতে বানিয়ে। পৃথিবীতে এমন কোনো সাহিত্য রচনা অসম্ভব যেটার প্যারডি আরেকজন লিখতে পারবে না। রামপ্রসাদ সেন যা লিখতেন তাঁর প্রতিবেশী অচ্যুত গোস্বামী একজন বৈষ্ণব হিসেবে সেটারই সদৃশ রচনা করে জবাব দিতেন। রামপ্রসাদ হয়ত লিখলেন, ‘আয় মন বেড়াতে যাবি।’ অচ্যুত লিখবেন, ‘কেন রে মন বেড়াতে যাবি?’ এই ঘটনা শাক্ত আর বৈষ্ণবের লড়াই। কবিতাটা উপলক্ষ্য। আমরা রবীন্দ্রনাথকে আক্রমণ করে লেখা দ্বিজেন্দ্রলালের ‘আনন্দ বিদায়’-এ দেখেছি ঈর্ষা কেমন বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে একজন সমবয়সী প্রতিভার মনেনজরুলের ‘বিদ্রোহী’ যদি মোহিতলালের ‘আমি’ থেকে জন্ম নিয়ে থাকে, ‘বিদ্রোহী’-ও কিন্তু জন্ম দিয়েছিল ভবকুমার প্রধান লিখিত ‘আমি ব্যাঙ’ নামক রচনার। মজার কথা, এই অনুকরণগুলো কিন্তু মুছে যায়নি, ইতিহাসে তিক্ত দাগ হয়ে এরাও আছে। কবিতা এখানেও উপলক্ষ্য, আসল ব্যাপার হল আত্মবিস্মৃত ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা, আর বাঙালি জীবনের কুটিল সীমাবদ্ধতা (অনুপম মুখোপাধ্যায় ।। পরিচালক ।। বাক্‌)


বিশ্বরূপ দে সরকারের কবিতা

গরজ

সমস্ত গাছেরা এত ছয়লাপ যে দিগ্বিদিকের ভেতরে আবার ভুলেছি
হাওয়ায় রয়েছে পইপই তবু এপ্রিলের বাউল ফুটেছে আকাশে
এইসব পলাতক দয়া কোনোদিন ধুলোবালি রাখবে না
এমন বাগান বিষন্ন এবং বাঁকা, কোনদিকে যাবে 
দক্ষিণ গাছের রাখা মিশে আছে

আসলে সে সংগ্রহ অবিকল বিস্ময়ে পূর্ণিমায়
চিবুক প্রস্তুত ছিল, নিপাট নীরব, তথাপি ঘনিষ্ঠ 
কীভাবে আছড়ে পড়ে শূন্যতায় মনে মনে জানে

থেকেছো বাদুড়ের বিলম্বে শিল্প মনে করে
ছিটোনো ধাতুর চূর্ণ...
এই আকাশ শূন্যলোক; খাঁজে খাঁজে নির্জন খেজুর
কীভাবে সাজাবো সর্বদাই 
যেটুকু জিভের মধ্যে সেটুকুই দানা বেদানা বানানো

সমস্ত নাছোড় এত অকারণ, এলোমেলো, জরায়ু গরজে শুধু একা


হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা

জঙ্গল

শহর অরণ্যচারী বুঝি কিছু চিতাবাঘ আছে ঘাপটি মেরে
তাড়া করে মাঝেমাঝে শহরবাসীকে;
বাসের গুমটির কাছে গেলে টের পাওয়া যায়
গরগর আঁধার ডাকছে তার
আঁধার, অপূর্ব খিদে, শ্বাপদের, জেগে ওঠে
আমাদের ঘরের ভিতর
চেটে খায় রক্তদাগ, কী বোঁটকা গন্ধ বাপ রে
মা বাপ উদ্ধার করে জানলায় জানলায় বসে থাকে
রাতের বাদুড় যেন
লক্ষ্য রাখে কারা কারা খাদ্য হলো আর কারা কৃতজ্ঞ খাদক
পচা চামড়াগন্ধ ছাড়ে শহরে মধ্যরাত হলে
শহর অরণ্যচারী আলো ফুটলে গুমটি থেকে
                                             ছেড়ে যায় বাস


সঞ্জীব নিয়োগীর কবিতা


সন্দেহ ও সদুপদেশ

সম্বল উঠেছে একা যাবে বলে, তারপর ভেবে দেখো
মরিয়া চাওয়ার দৃশ্য যদি হয়
মারীসাক্ষীচোখ, যদি

মরু-উদ্যত চলে যায়, গায়ে মেখে অবহেলা, নুনজল
অসহ্য নিজেকে দিয়েছ যতদূর চোখের রূপটান, চুষে খাও
রক্তের দামামা;  

কাঁদে বক, কাঁদে খোকা-খুকি!    

তবু থাকি লন্ঠনের কাছে নতজানু, আভূমি হাসির ছলে
লুটিয়ে দিয়েছি ছেলেখেলা, বেলা সন্ধ্যাকাল...  

ঝুলে থাকে মন, গোচারণে, টেকসই ডালে
কৃষিকাজে, কীটমুখি সোনার ফসলে
লেখাকাজ একার লাঙলে, দোদুল্য
    
ওইদিকে লেলিহান জেনো
ওই দিকে বরফকঠিন
ওই দিকে ছবি তোলা হয়
ওই দিকে হাসি দিয়ে দেখো।
 


অরিত্র সান্যালের কবিতা

আমার লেখার কথা

যে কোনো সময় কোল থেকে উল্কা খসে যায়, এমন ভগ্ন বাৎসল্যের আকাশ আমাদের সামনে এলো।

এখন ক্লান্ত এক ছায়া আয়নায় পড়ার শব্দ আসছে।

শব্দ এলো আমার একেকটি দুঃখ দূরদেশে কেউ কেউ প্রসাধন হিসেবে ব্যবহার করে – তার

নিজের আঙুল বাড়িয়ে আমি হাওয়ায় রাখছি – শূন্যতার সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ।

ওগো, তোমাদের উত্তুরে হাওয়ায় নাকি আলো জমে গিয়েছিল একবার!

ধরো, একটি অতিকায় রূপের কপালে আমার বাল্যস্মৃতি – গলায় জীবনের বৃত্ত; পায়ে জল শুকিয়ে যাওয়া দৃষ্টির আক্ষেপ বাজছে

ধরো, আকাশের সেই জমে যাওয়া আলো থেকে একটু একটু মৃত উত্তাপ নেমে আসছে –

এ সমস্ত কিছুই আমার লেখার কথা ছিল চোখ দিয়ে – এখন তলায় কত কালি

ধরো, অন্ধকার সময়ে আমার একটি অপূর্ব কটাক্ষ ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে তারার আলোয়

দুটি ঠান্ডা বরফের চোখ দিয়ে
নিজের মেরু বরাবর
নিজেকে
আমি তাকাই 


নীলাব্জ চক্রবর্তীর কবিতা

মোম

একদিন দেখা হোলো অনেকদিন
গাছেদের গায়েগতরে
স্বর
লিখে রাখা
মোম এক বৃন্ত
কেঁপে
পাতানো বাক্যের ভেতর যারা চামড়ার হরফ
তোমাদের জাদুঘরে
এইভাবে যত ধ্বনি
জল হয়
পারভীন নামের রোদ
ডাকতে ডাকতে
রোগা শব্দেরা
ভরা জ্যামিতির বাইরে ঘুরে আসছে এখন...


জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা

 



শুভ আঢ্যের কবিতা

ম্যাড মঙ্ক

১৪
ওই জল, তার নিচে পিরানহা আর শ্যাওলা
সেই ফ্লোরার ভেতর তোমার ভাইকে
দেখে ফেলছি আমি, আমি দেখছি তোমার ইজেরের ভেতর
ফাটল সিক্ত হয়ে উঠেছে, সেই জল... আমি দেখতে
পাচ্ছি পাচার হয়ে যাচ্ছে সোনা বোঝাই মন অথচ
তার দাম শ্রমিকের ঊরুতে লেগে থাকছে, তোমাদের
কাঠের বাড়ির ভেতর তোমাদের বাবা-মা একদিন
রাত্রে কুড়ি বছর পর চুমু খেল, তুমি দেখে ফেললে,
তোমার ফ্রকের তলায় যেসব পায়রার কথা ছিল
তা তুমি বাৎচিত করে ফেলে দিলে, আর নতুন পায়রা
এলো সেখানে - এখন তুমি অন্বেষণ করো একে কি বলে
ডাকবে? আমার ঘোলা চোখের ভেতর যে পিঙ্গল মণি
তার দিকে তাকালে তৃষ্ণা, দাড়ির ভেতর ফনা, এই
ইকোসিস্টেম তুমি কিভাবে মেনে নেবে? সম্মোহন
বলে কিছু নেই, তুমিও দেখতে পাবে জলের তলায়
বেঁকে যাওয়া ঘরের ছবি, প্রতিসরণের কালে আগের
সম্পর্ক, শুধু চোখ নষ্ট করে ফেলো, শুধু দৃষ্টিটুকু রাখো
ওই মনের ভেতর... দেখতে পাচ্ছ? একেই কি
বিজ্ঞান বলে? একেই কি আমি তোমার ভেতর ঢুকে পড়া
বলবো? এই আমাকেই কি তুমি উন্মাদ বলবে?


১৫
ঈশ্বর তোমার সেই তীক্ষ্ণতা ক্ষমা করুন
তোমার কেটে যাওয়া শব্দ ঘিরে আমি রাসপুতিন
কোনো কবিতা লিখবো না, শুধু তোমার ঈশ্বর
কামনা বঞ্চিত, তোমার ইচ্ছা তা'ও ওই রঙে সেজেছে

ওখানে অন্ধ কার চোখে যে দেখছে তোমার তীক্ষ্ণতা
আমি ভাবি, আমার নেশার ঝোঁকে কতগুলো ঘোড়া
আমার নেশার ঝোঁকে উদোম ঈশ্বর তোমার সাথে
কথা বলে, আমার নেশার ঝোঁকে তোমার তীক্ষ্ণতায়
কেটে যাই - এই জীবন এক পরিব্রাজক যেন শীতের
রাতে দরোজা থেকে দরোজায় ঘুরছে, যেন পাখপাখালির
ভেতর বসে থাকতে থাকতে নিজের স্বর হারিয়ে ফেলেছে
যেন নিজের পায়ের ছাপ ভুলতে বসেছে, ওই জানলা
ধারণা তোমার, ওর পেছনে কোনো দৃশ্য নেই যা তুমি
কেটে উঠবে, ওই কামনা স্থির জলে তোমার আমার
প্লবতায় ভেসে থাকার ইচ্ছে, এসব নিয়ে কোনো
কবিতা লিখবো না আমি গ্রিগরি, শুধু তোমার ঈশ্বর
মঙ্গল তোমারই করুন, তোমার করুণ ছায়া হোন,
যা কখনও আমি সাদা বরফের ওপর দেখে থাকবো


১৬
ফিওডোরোভনা, তোমার প্রতি আমার প্রেম নেই
তবু এক সুর আমাকে ডাকে, আমি সাড়া না দিয়ে
কি ভীষণ শীতে একা বসে থাকি, ঊনিশতম বসন্ত
পেরোচ্ছে এই গ্রিশকা, তুমি বিংশতম আমার...
তোমার প্রতি করুণা নেই কোনো, শুধুই জৈবিক চেয়ে থাকা
তোমার ভেতর এক লম্পট, তুমি গ্রহণের কালে
আমার বর্জন পারবে কি উপেক্ষা করতে? অতএব
আমাদের তিনখানি সন্ততি উপভোগ করো, আমাদের
কামের সম্পর্ক উৎসব হোক, আমাদের ভেতর
চিরপরিচিত বসন্তের কোকিল নয়, ঈশ্বর ডাকুন...

ওহ ফিও, কি নিদারুণ রুটির মতো তুমি, আমি কি করে
সাড়া না দিয়ে... দেখো, এই রাশিয়া জুড়ে লজ্জা
আমরা লজ্জাহীন হই, আমাদের ভেতরে ঈশ্বর তাঁর
চোখ নামিয়ে দেখুন কি নিদাঘ দুটি শরীর পরস্পরে
বসেছে, আমাদের কাল হোক... যৌথরাষ্ট্র হোক
এই পোকরোভস্কো পেরিয়ে, শীত পেরিয়ে, এই
ঈশ্বরকে পেরিয়ে আমরা সেখানেই অপ্রেমে থাকবো


শানু চৌধুরীর কবিতা

ঠাকুমাকে লেখা কবিতা

বুকের কিনারে ভেসে আছে পুষ্টির অসহায় ফেনা
তেমনি বুদ্বুদসমান জন্মলালায় 
ফুঁ দিতে দিতে হাঁপিয়ে উঠছে ঠাকুমা
হয়তো নিস্তব্ধ হয়ে যাবে বাঙাল ভাষার আঁচল
এখন যন্ত্রের ভাঁজে, উপেক্ষিত জলের রাশিকণা
সকালের খাবারে জমিয়ে দেয় বাসি সর
অক্ষম হয়ে আসা নিরীহ বকুলের বাক্যরচনা
আমি চাইনি
দেখতে চাইনি
কাচের কাঁচের মতো টলটলে ভুল বলার দিকে
সারিবদ্ধ হাসপাতাল
তবু যেন গড়িয়ে যাচ্ছে সযত্নে বেঁধে দেওয়া সরু বিনুনী
আর আমাদের রুমালে জমা হওয়া অর্থময় ভারী পাথরের তৃষ্ণা


অয়ন্ত ইমরুলের কবিতা

বীণা তার পাণি

স্কেচ ভরা মেঘ
আর পথকরা মাসকারা
ইতি কারও চোখে মুদিত ট্রান-জিস্টার
ভীষণ বাজা কুহু তার বিহিত
একলা আমার হাওয়া হেরে
ফিরে আসে
এই যে রুকস্যাকে ভর সন্ধে
তার সিন্টিলেশনে থেমে যায় ঝিঁঝিঁর
বীণা তার পাণি
কারও কারও চাকার পাখি
ক্রিং মিটিয়ে
চেইন পড়া চামেলি অতি জড় আপ
বীকন এই তিরি
তুফান ধরে উড়ুক্কুকে কুটিকুটি
গান ফান পরায়
নিবিড় হাঁসকল বিরান দোলায়
কাঁপিয়ে যায়
নদীবর্তী বাড়ি

ট্রলিপোল

মিনতি মোড় থেকে একটু দূরে যতটা বরফকুচির ঢেউ আছড়ে পড়ে.....
এই সেই কুণ্ডলী ঘুম হারা কুকুর,এত দ্রুত দৌড় করাচ্ছিল ধূলশুরার হাটবার,বিলুপ্ত বেদনার পাশে একটা বেদানা ফেটে লাল হয়ে অপেক্ষায় ছিল।হাওয়া এমন..... স্বস্তিকা চিহ্নের খোঁজ না দেখিয়ে বাঁধলে কালো টাই
আর লং ড্রাইভ জুড়ে অন্ধ হুতুমের গান
গান এমন....ঝুম বর্ষার তেরে কেটে ধা
আমরা অনেকটা অমাবর্ষায় হলহল মিটিয়ে ট্রলিপোল....
হেন এই বৃষ্টিবাহুল্যে শিশুদের হাসিফলা দেখে রিমিকি শুধু খুলছে না তার তা থৈ



সুহিতা সুলতানার কবিতা

নীল আত্মার সংরাগ

জলের ভেতর দিয়ে পথ কেঁটে হেঁটে গেছি বহুদূর
দূরে আয়ুরক্ষার মন্ত্র হাতে দাড়িয়ে আছে একাকী 
গন্তব্যহীন এক সুর সংরাগ ! ভোরের আলপথ বেয়ে
টুকরো টুকরো স্মৃতি ছড়িয়ে দিচেছ সর্বত্র !আমি
যদি আমাকেই খুন করে খুনী হই তাহলে কী সব 
নক্ষত্র খসে পড়বে আমার বুকের ওপর! প্রিয়
গিটারের কান্নার ব্দে স্তব্ধতা 'তুমি' নামক শব্দের 
ওপর রংধনু রং মেখে ড়িয়ে পড়বে নীল আত্মার
সংরাগ মেখে! মাঝরাত অবধি শ্বাসরুদ্ধকর
অচিন্তার দাহ মেঘজলে মেতে ওঠে জলডুবি 
খেলায় !


রাজা সিংহের কবিতা

গড়ানো

যেকোনো আওয়াজ হলেই তুমি এসো আসো কেনো? সেও কি শব্দেরই কেউ হয়? না কি রস
টুপিয়ে পড়ছে হে মাধবীলতা আর তাঁr বারুদ  তার দুধ উধাo কোথাও
!
শৈশবে পুঁতে আসা দাঁত কীভাবে যে ছুঁচিবাই হলো
?

পীঠের ব্যথার মতো গাল যার সেও কি দয়াল শুধুই স্পার্ম
হিসির ওষুধ ঔষধ হবার চেষ্টা করছে ইউ অর্নার 
!
এইসব বেজে ওঠা মাথা, থেমে থেমে উঠুক কিংবা লাজুক হোক খুব
আমারও শাঁখের শোক; কান্নারা বাষ্পেরই তো
ছোটো পা বলুন
সবুজ জাহাজ জানে তোমার হলুদ ঠোঁট কতটা আমাদের বোঝায়
খোলা খোলা দরজায় কশাটে হয়ে উঠছে স্বপ্ন আর তার পুরানো নাবিক বোধ



সোনালী চক্রবর্তীর কবিতা

ভুল

মঞ্চ প্রিয় ছিলো....
সে এক অদ্ভুত আলো,
নর্তকী কে নয় এ চরাচরে?
তবুও স্বীকৃত আঙ্গিকে কিছু পৃথকী সম্মান বরাদ্দ থাকে...
এভাবে বলা যাক,
যখন ঘুঙুর নিত্যতা রাখতো ঝড়ের,
মঞ্চ ছিলো পবিত্র দেবালয়... 
হৃদভূম থেকে কখন যে কোন ঋতু রিফিউজি হয়,
কোন গণক জানে?

ক্রমে কাব্যলোক....
বিপুল যন্ত্রাণুষঙ্গেও এখানে আবহসঙ্গীত বিসদৃশ ঠেকে,
মহার্ঘ্য সুরা ও বিষে নেশার তফাৎ যেমন অস্তিহীন,
অবিকল অভিন্ন নির্বাচনী প্রচার ও কবিতাপাঠের মেহফিল,
প্রতিশ্রুতিকে এতোই শূণ্য গর্ভ হতে হয়?
অথবা সত্যকে নিদারুন অপলাপদুষ্ট?

শোনপুরের ময়ূর যেভাবে চড়ুই হয়ে ওঠে,
অকাল পৌষালী বৃষ্টিতে....
সেভাবেই ঝরে যায়,
শিরোভাগ থেকে উচ্চতা,
শিরদাঁড়া সাপেক্ষে ঋজুতা
আর আত্মা থেকে অহং,
কলম থেকে দৈবীও সম্ভবত...

অতঃপর অন্ধকার,
সমাহিত প্রার্থনা....
ক্রমোজ্জ্বল,সফল ও বিখ্যাত হয়ে উঠুক কবি,বন্ধু ও সঙ্গিনীকুল,
জ্যোতির সার্থকতায় নিশ্ছিদ্র তমসার প্রয়োজন খুব,
কালের ভ্রান্তিবিলাসে কতই তো উন্মাদ আসে,
সংযোজিত হোক নতুন নাম,
কোনও জন্ম,কোনও প্রাণ,
স্বয়ং সর্বৈব অর্থে, 
সৃষ্টির দুর্দম অলীক ভুল...


জয়িতা ভট্টাচার্যের কবিতা

ভুট্টা

আজ বিকেলের রোদেলা ফুটপাতে
আমাকে ডেকে নিল সে
অনেকদিন পর ভুট্টা
আহ! 
কী দারুন হাল্কা আঁচে সেঁকে নেওয়া
লেবু টিপে 
নুন স্বাদ
প্রতিটা দানার গায়ে জিভ
নীচে থেকে ওপর....
বিনয় বাবু সঙ্গে মতান্তর 
এখানেই।
দানাগুলি ডাঁসা
সুন্দর  হাল্কা ক্রীমরঙ
বিখ্যাত করেছে
ওকে
একেকটা কামড় 
মনে পড়ে কত কিছু 
অবিস্মরণীয়
রগ ফুলে ওঠে, ছিঁড়ে
নিতে হয়
প্রতিটি
দানা
মুখে ভেতর আশ্লেষ 
মাথায় চড়ে বসে 
এভাবেই আস্তে আস্তে
বেরিয়ে পড়ে
নরম দণ্ডটা।
ভুট্টা খেতে গিয়ে মানুষের
প্রথম
হিংস্রতা শেখা
লোভ
আশপাশে চোখ জ্বলজ্বলে
ভুট্টা খেতে হবে
সভ্যতা
ভুলে।


সাজ্জাদ সাঈফের কবিতা

মৃতের ক্বলব

ইয়েমেন, শুকনো পাতায় বসা রক্তবলাকা-
আমাকে জাগিয়ে রাখে, এ যেনো মুহুর্তকাল, মরুবাগিচার ধারে, কাছে এক বারুদগন্ধ এসে
তন্দ্রাকে ধাক্কা দিয়ে ডাকে, স্বপ্নকে অবরুদ্ধ করে;

শিশুমৃত্যুর ভাষা অযুত পিপার গায়ে
শুধু রক্ত, শুধু কলিজা এফোঁড় ওফোঁড় করা
গ্রেনেডের কালি--

ইয়েমেন, পিপাসা গোপন করে শুদ্ধ গণিতে
শূন্যতা লেখা তুমি শিখে গেছো নাকি? সারা গায়ে ফুসকুড়ি নিয়ে
হাঁটছে আরব, মানুষের বিশ্বাস থেকে বিষাক্ত পিঁপড়া এসে জড়ো করে রাখছে বালি!

আমাকে বিদ্ধ করো আর্তচিৎকারে, ইয়েমেন, খুলিতে সাজাও এখন অগ্নুৎসব;
মক্কাকে তাওয়াফ করে মারী ও মৃতের ক্বলব
প্রতিধ্বনি শেষ হলে মাটিও ভিজছে খুনে;

চারদিকে কোলাহল, আগুন! আগুন!
মৃত্যুকে ডেকে বলো 'প্রভুর কসম'
বলো 'কুন, ফা-ইয়া কুন'!


আয়না

জানি না প্রসঙ্গে কে ডুব দেবে আমার সাথে?
মাটি গায়ে মাখা থাকে শীতের দুপুরে
তালগাছ বক নিয়া সুখী ও সরল
জানি না এমন করে কে হবে শিকার!

আমি তো কবেই গেছি পঙ্কিলতায়
পাতা আর পাড়ভাঙা নদীর ছবিতে
গান গায় ভিখারীরা গলায় গরল
গান গায় মরণ এসে শিশুর পাঁজরে!

আমাকে ধাক্কা মারে নগরীর ধোঁয়া
পাতক আমিও জানে সরু করতোয়া
কে যাবে, জ্বলন্ত চোখ শিকে ঢুকিয়ে
দৃশ্যকে আগুনে দাও, দূর করো স্মৃতি!

এখন পারদ ওঠা আয়না আমিও
কে দেখে কাহার ছুরত, কে নিবে আলো?

এইভাবে হয় না কিছু, হবে নাকি ঘুম?
রক্তে আছাড় খেয়ে, পড়ে আছে দ্বিধা
পড়ে আছে মুখছবি, হাসি হাসি ভাব
কাহার‌ও আপোষ লাগে, কাহার‌ও প্রতিভা!


জেব্রাক্রসিং

এই শহরের রাস্তাগুলাতে জেব্রার গায়ের ছাপ, স্থির, এখানে বিশ্বাসের স্পর্শ  অনেকগুলা টাকার ব্যাপার, আমাদের থেমে যেতে হয় কখনো, ভেঁপুর মধ্যে ভৎর্সনা, চোখের মধ্যে পূর্ণ হচ্ছে ঘাটশাসিত নদী-

বৃত্তকে উহ্য রেখে কোলাহলে নেমে যাচ্ছে ব্যাস
কতকিছু নতুন লাগে, শুমারিতে ঢুকে যাচ্ছে নবজাতকের শ্বাসকষ্ট

তারপর‌ও জোৎস্নার ভিতর শুনতে পাই
ধাত্রীর হাসি, আমার‌ই প্রথম চিৎকার;
গহন থেকে বুক চিঁড়ে উঠে আসে উদ্যান;

তারপর‌ও তর্কের মধ্যে বিপন্নতাকে ভালোবাসি আমি
সমস্ত ধূসরতাকে স্পর্শ করে ডাকি, বেঁচে থাকাকে অধ্যাদেশ বলে মনে হয়;
আর, জেব্রাক্রসিং থেকে নগরবাসী
নির্দ্বিধায় ঘুরে যাচ্ছে কফি কফিনের ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গে!


হৃদয়

যার যাবে সকল গল্প ফুরিয়ে
পরাজিতদের পানশালায় তার শুধু মাতলামী দ্যাখে লোকে, তার শুধু অশ্রুত ক্ষত
চারপাশে কাতর তমসা জুড়ে
খাবি খায়, খাবি খায় ডুবে!

বিপন্ন জ্যোতির কাছে রাঙা হয় সূর্যাস্ত, এরপর‌, 
ধীরে ঝরে বেলি ও বকুল; যার শুধু বেদনার আস্তিন
শারদে পূর্ণ হলো, তার কাছে হাত পেতে বসি,
তার থাকে নাকি অনির্ণীত গান?
হৃদয়ে ব্যাপ্ত থাকে স্বর ও লিপি কোন‌ও?

হৃদয় এক সাইলেন্সার নাকি?
বেদনাবন্ধনী, জড়াজড়ি তার গায়ে?