বাক্‌ ১৩২।। যশোর রোডে সেপ্টেম্বর ।। অ্যালেন গিন্সবার্গ ।। অনুবাদ : শৌনক সরকার



যশোর রোডে সেপ্টেম্বর

আমরা চেয়ে আছি লক্ষ লক্ষ বাচ্চার দিকে যারা চেয়ে আছে আকাশের দিকে,
তাদের পেট ফুলে ঢোল,তারা চেয়ে আছে বড় বড় গোল গোল চোখে
যশোর রোডের ওপরে আছে লম্বা বাঁশের কুঁড়ে
যেখানে হেগে ফেলার মতো জায়গা নেই বরং বালির নানাপথ আছে হাগার জন্য

লাখ লাখ বাবারা বর্ষায়
লাখ লাখ মা তীব্র যন্ত্রণায়
লাখ লাখ ভাই দুঃখ যন্ত্রণায়
লাখ লাখ বোন আজ নিরুপায় আজ তাদের যাওয়ার জায়গা নাই

দশ লাখ পিসিমা মারা যাচ্ছে স্রেফ রুটির জন্য
দশ লাখ পিসেমশাই স্রেফ হাহাকার করছে মৃতার জন্য
পিতামহরা আসলে লাখ লাখ উদ্বাস্তুর দল
মাতামহরা আসলে লক্ষাধিক পাগল

লাখ লাখ মেয়েরা কাদা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে
লাখ লাখ বাচ্চারা বন্যার জলে স্নান করে যাচ্ছে
লাখ লাখ মেয়েরা রাস্তায় বমি করছে, কাতরাচ্ছে তীব্র যন্ত্রণায়
লাখ লাখ পরিবার হেঁটে যাচ্ছে আশাহীনতায়
লাখ লাখ উনিশশো একাত্তরের অতৃপ্ত আত্মারা
যশোর রোডে আজ সবাই ঘরছাড়া যাদের মাথার ওপর সূর্য
দশ লাখের বেশি মারা গিয়েছে,
অন্যরা যারা পারছে তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতার দিকে হাঁটছে

ট্যাক্সিতে আমি তখন সেপ্টেম্বরের যশোর রোড ধরে
পাশে তখন গোরুর গাড়ি যাচ্ছে কাঠকয়লা ভরে
জলভর্তি মাঠ পেরিয়ে,বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া নর্দমায়
গাছে থাপা আছে ঘুঁটে, কুঁড়েঘরে প্ল্যাস্টিক সাঁটা আছে ছাতে

মিছিলে যেন আজ ভিজে মাথায় পরিবারগুলো হাঁটছে
বড় হওয়া থামিয়ে সমস্ত ছেলেরা কথা বলতে বলতে ঘন ঘন মাথা নাড়ছে
দেখ হাড় বেরিয়ে যাওয়া আর গোল চোখ নিয়ে
মানুষের ছদ্মবেশে অভুক্ত কালো দেবদূতের দল ওরা

উবু হয়ে বসে মা কেঁদে যাচ্ছে আর কাঁপা আঙ্গুল তুলে দেখাচ্ছে তার ছেলেকে
সরু পায়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন তারা,লাগছে তাদের বয়স্ক নান
ছোট্ট শরীর হাতদুটো মুখের কাছে এনে করছে প্রার্থনা
পাঁচ মাস সামান্য খাবার পেয়েছে যেদিন এখানে বেঁধেছে আস্তানা
একটা মাদুরে ছোটো এক ফাঁকা বাটি নিয়ে
দু হাত তুলে বাবা তাদের দিকে ধরে এগিয়ে
ওদের মায়ের চোখে জল এসে যায়
মা মায়া কাঁদে যন্ত্রণায়
দুটো বাচ্চা যেন নারকেল পাতার ছাদের আশ্রয়ে থাকে একসাথে
তাকিয়ে থাকে আমার দিকে কোনো কথা না বলে
চাল দেয় মেপে, মুসুরের ডাল যেন তলানিতে এসে ঠেকে
গুঁড়ো দুধ শুধু রয়ে যায় ক্লান্ত শিশুদের জন্য
নেই কোনো সবজি, নেই কোনো টাকা এমনকি পুরুষ যেন বেকার
চারদিন চলে যায় চাল যতক্ষন খাওয়া জোটে আজ
তারপর অভুক্ত রয়ে যায় বাচ্চারা টানা তিনদিন
পরের খাওয়া তখন বমি হয়ে বেরোয় তখন
যশোর রোডে মায়েরা কেঁদেছে আমার পায়ে পড়ে
বাংলায় বলেছে বাব দয়া করে
মাটিতে পড়ে আছে যখন ছেঁড়া পরিচয় নির্দেশিত কার্ড
তখনও স্বামী বসে অপেক্ষা করছে ক্যাম্প ঘরের দরজায়
শিশুটি খেলছিল যখন আমি তখন চান করছিলাম বৃষ্টির জলে
এখন ওরা আর আমাদের খাবার দেবে না  বলে
টুকরোগুলো গচ্ছিত আছে তাই আমার সেলুলয়েড খাপে
নির্দোষ শিশুর খেলা আমাদের মৃত্যু অভিশাপে
দুটো পুলিশকে ঘিরে রেখেছে কয়েক হাজার ছেলেরা
ভিড় করে অপেক্ষা করছে প্রতিদিনকার রুটির টানে বইছে আনন্দধারা
বড় বড় বাঁশ আর লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে
বাড়ি মেরে ঠিক লাইনে দাঁড় করাবে
আর না খেতে পাওয়া মানুষগুলো বাগড়া দেয় তাতে
মাঝেমধ্যে লাইন ভেঙে সামনের দিকে চলে আসছে
গোলাকার সেই জায়গায় , দেখতে বিদঘুটে এক হাড়গিলে
দুভাই নেচে উঠে মঞ্চের দিকে যখন এগোলো
পাহারদারেরা বাঁশি বাজাতে বাজাতে লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে গেল
কেন এইখানে শিশুদের একত্রিত করা হয়েছে
কখনো হাসছে আর কখনো জায়গার জন্য একে ওকে কনুই মারছে
কেন এই অপেক্ষা, কেন এত নিদারুণ ভয়
আসলে এই বাড়িতেই ওদের রুটি দেওয়া হয়
রুটি দেওয়ার দরজা দিয়ে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল "আজ রুটি শেষ"
হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যেন আনন্দে প্রার্থনা করে উঠলো "আজ রুটি শেষ"
চিৎকার করে উঠলো শিশুরা "আহা বেশ, বেশ"
বাড়ির দিক থেকে দৌড়োও তাঁবুতে যেখানে বড়রা অপেক্ষায় আছে
বাচ্চারা যথা আজ্ঞা বলে ছুটে যায় রুটি নিয়ে কাছে
আজ আর কোনো রুটি নেই বসার জায়গা অব্দি নেই
শুধু আছে অসুস্থতা আর আছে হাগার ভার
মাসের পর মাস অপুষ্ট রয়ে যায় করোটি
যা কিছু খাচ্ছে তা পায়খানার মাধ্যমে বেরিয়ে যাচ্ছে একেবারে
নার্স রোগের কার্ডে এনট্রোস্টেপ দেখায়
পায়খানা বন্ধ করবে বলে আর না হলে ক্লোরোস্টেপ
রিফিউজি ক্যাম্পগুলো যেন হাসপাতালের ছোট্ট ঘরে বন্দি
সদ্যোজাত শিশু যেন ল্যাংটো হয়ে পড়ে আছে মায়ের কোলে
তাদের সপ্তাহখানেকের চোখগুলো যেন অসুস্থ বাঁদরের মতো
এইভাবেই পেটের রোগে, রক্তে বিষক্রিয়া হয়ে মারা যাবে কয়েক হাজার লোক
সেপ্টেম্বরের যশোর রোডে যখন রিকশায় চেপে যাচ্ছি
৫০,০০০ আত্মাকে যেন একটা শিবিরে দেখতে পাচ্ছি
সারিবদ্ধ বাঁশের কুঁড়েঘর ভেসে যাচ্ছে বন্যায়
খোলা ড্রেন আর ভিজে পরিবার তখন খাবারের খোঁজে
আসতে পারছেনা জল ভরা বর্ডার ট্রাকগুলো খাদ্য জল পেরিয়ে
মার্কিনি যন্ত্র যারা দেবদূত হয়ে দেখা দেয় তাদের দয়া ভিক্ষে করছি
কোথায় আজ রাষ্ট্রদূত বাঙ্কার?
যে বাচ্চারা খেলছে তাদের কি মেশিনগান দিয়ে গুলি করে মারছে
মার্কিনি হেলিকপ্টার?
মার্কিনি সাহায্যকারী হেলিকপ্টারগুলো আজ কোথায়?
তারা এখন ব্যাংককে মাদক পাচারে ব্যস্ত
কোথায় এখন মার্কিন বিমান বাহিনী?
উত্তর লেওসে তারা বোম ফেলে যাচ্ছে রাত্রিদিন
রাষ্ট্রপতির সেনাদল কোথায় এখন?
কিংবা তাঁর সাহসী নৌসেনা
যারা জোগাবে ওষুধ, খাদ্য ইত্যাদি?
তারা এখন জাপান বোমা ফেলে তৈরি করছে বিভিষিকার উত্তর ভিয়েতনাম
আমাদের কান্নাগুলো কি হারিয়ে গেছে? কাঁদছে কারা এই যন্ত্রণায়?
কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে পরিবারগুলো এই বর্ষায়?
যশোর রোডের বাচ্চারা তাদের চোখ বন্ধ করে ভাবে
আমরা কোথায় যাবো যখন বাবা যাবে মরে
কার কাছে ভাত চাইব আমরা, কার কাছে চাইব যত্ন
কে এনে দেবে রুটি আমাদের হাগা আর বন্যার এই দূষিত নরকে
লাখ লাখ বাচ্চারা একা বরষায়
লাখ লাখ বাবারা কাঁদছে যন্ত্রণায়
ওদের দুঃখে যেন বেজে ওঠে পৃথিবীর সব জিভেরা
তাদের গলার আওয়াজ যেন ছড়িয়ে পড়ুক আমাদের অজানা ভালোবাসার জন্য
বৈদ্যুতিক যন্ত্রণার সেই ঘন্টা বাজাও তীব্র ভাবে
সচেতন আমেরিকান মস্তিষ্কে যেন রেজোনেট হয় তাতে
আমরা কতগুলো বাচ্চা যারা স্রেফ হারিয়ে গিয়েছি
আমরা যাদের ভূত হতে দেখেছি তারা কারোর কন্যাসন্তান ছিল একসময়
ওই কি সেই যন্ত্রণাভরা আত্মারা যারা হারিয়েছে যন্ত্রণা
বেজে ওঠে তীব্র সঙ্গীতেরা তাই,যারা পারবে তারা সাহসভরে কেঁদে নাও একবার
বালির তৈরি ড্রেন, খড়ের চাল আর তার পাশে কান্নার রোল ওঠে
বড় বড় পাইপের মধ্যে ঘুমে কাদা ওরা গু ভর্তি মাঠে
পাম্প কুয়োর পাশে অপেক্ষায়, ধিক্কার জানাই এই পৃথিবীকে
যার শিশুরা এখনো খেতে না পেয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছে মার কাছে
আগেও কি আমি বুঝিয়েছিলাম নিজেকে এইভাবে?
কী করব আমি সুনীল কবি আমি বললাম ?
কোনো পয়সা না দিয়ে কিভাবে এগিয়ে চলেছি আমরা?
নিজেদেরটা ভাববো পরের নয়, এমন কি ভেবেছি আমরা ?
আমাদের শহর আমাদের গাড়ি কি হবে পাত্তা দিয়ে?
খাবারের টিকিটে কি কিনব আমরা মঙ্গলগ্ৰহে গিয়ে?
কত লাখ মানুষ নিউ ইয়র্কের সান্ধ্য ভোজে রাতের টেবিলে বসে
হাড় ও শুয়োরের রোস্ট খায়
কত না লাখ লাখ বিয়ারের টিন ছুঁড়ে দেওয়া হল
মাঝ সমুদ্রে, তার দাম কত কেউ কি জানে?
চুরুট, পেট্রল, রাস্তার পিচ সবকিছুর
দুর্গন্ধে এ পৃথিবী যেন ভরিয়ে রাখে, আবছা করে রাখে উজ্জ্বল তারাদের ভিড়
তোমার বুকের ভেতরে চলতে থাকা যুদ্ধটা শেষ কর এক নিশ্বাসে
তোমার মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলো, চোখে দেখো সবকিছু, স্বাদ নাও চোখের জলের
দয়া করো আমাদের, লাখ লাখ ভুতেদের দয়া করো
অদ্ভুত এই সংসারে এই টিভি গ্ৰহে
আরো কত লাখ বাচ্চা স্রেফ মরে যাবে এভাবেই
মরে যাবে সেইসময় যখন আমাদের মায়েদের তাদের মহান প্রভুকে উপলব্ধি করার উৎকৃষ্ট সময়
আরো কত ভালো বাবা সশস্ত্র সেনাবাহিনী তৈরি করার জন্য ট্যাক্স দেবে
যারা গর্বের সঙ্গে বাচ্চাদের মারবে
মায়ার এই অলীক দুনিয়ায় কত আত্মা হেঁটে গেল যন্ত্রণায়
কত শিশু হেঁটে গেল অলীক বর্ষায়
কত পরিবার যাদের গর্তে ঢোকা চোখ স্রেফ হারিয়ে গিয়েছে
কত মাতামহ মরে ভূত হয়ে গেছে
কত ভালোবাসা রুটিই পেল না কোনোদিন
কত পিসিমার মাথায় ফুটো ছিল
কত বোন ছিল যাদের মাথার খুলি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে
কত পিতামহ জন্মের মতো বোবা হয়ে গেছে
কত বাবা দুঃখ দুর্দশায় কাঁদছে
কত ছেলের যাওয়ার নেই কোথাও
কত মেয়ের নেই কোনো খাবারের দলা
কত পিসেমশাইয়ের অসুস্থতায় পা ফোলা
লাখ লাখ শিশুরা যন্ত্রণায়
লাখ লাখ মায়েরা বর্ষায়
লাখ লাখ ভাইয়েরা দুঃখের অন্তিম সীমায়
লাখ লাখ বাচ্চার কোথাও যাওয়ার নেই, তারা আজ নিরুপায়




                 চিত্রঋণ : রঘু রাই

2 comments:

  1. আশংকা আমাদের পায়ে পায়ে

    রীনা তালুকদার

    ----------------------

    ফসলের মাঠ জুড়ে উন্মুখ তৃষ্ণায়

    তোমার জন্যই তুমুল আকাঙ্ক্ষা

    সুখের পারাবত উড়ে যায়

    শান্তির বার্তা দিয়ে

    শহর -গ্রামের দূরত্ব কমে যায়

    মুগ্ধতার সেতুবন্ধনে

    মানুষে মানুষে আত্মীয়তার গলাগলি

    পিতার চোখে সন্তানের মুখশ্রী আয়না

    সোনালী সবুজে শ্যামল বাংলার

    ধানীমুখ হাসিতে তুমি উচ্ছ্বল

    প্রিয় জনতার দুঃখ দুর্দশায় ম্রিয়মান

    যার রক্তের উত্তরসুরী তার

    সাহসিকতা তোমাকে করেছে মানবিক

    জ্যোৎস্নালোকের স্বপ্ন আমাদের

    বুক পকেটের আভিজাত্য

    চারিদিকে ওঁৎ পেতে আছে সাপ ছোঁবল

    চাইছো সবার হোক ভাল

    তোমার সুমধুর কণ্ঠ যখন নদীর সঙ্গীত

    বাতাসের কাণে বাজে এ কোণ আশংকার বিউগল ?

    অতটা উদারতায় যেও না; থামো. ..

    দেবালয়ের সেবককে স্থানচূ্্যত করলেই

    দেবোত্তর সম্পত্তির হবে কড়ি কড়ি ভাগাভাগি

    ফ্রেশ রুমের কমোডেও লুকিয়ে থাকতে পারে সাপ

    সাবধানে ফেলতে হবে চরণ যুগল
    চাই না জাতির আর কোনো গোল্লাছুট !

    ReplyDelete
  2. আশংকা আমাদের পায়ে পায়ে

    রীনা তালুকদার

    ----------------------

    ফসলের মাঠ জুড়ে উন্মুখ তৃষ্ণায়

    তোমার জন্যই তুমুল আকাঙ্ক্ষা

    সুখের পারাবত উড়ে যায়

    শান্তির বার্তা দিয়ে

    শহর -গ্রামের দূরত্ব কমে যায়

    মুগ্ধতার সেতুবন্ধনে

    মানুষে মানুষে আত্মীয়তার গলাগলি

    পিতার চোখে সন্তানের মুখশ্রী আয়না

    সোনালী সবুজে শ্যামল বাংলার

    ধানীমুখ হাসিতে তুমি উচ্ছ্বল

    প্রিয় জনতার দুঃখ দুর্দশায় ম্রিয়মান

    যার রক্তের উত্তরসুরী তার

    সাহসিকতা তোমাকে করেছে মানবিক

    জ্যোৎস্নালোকের স্বপ্ন আমাদের

    বুক পকেটের আভিজাত্য

    চারিদিকে ওঁৎ পেতে আছে সাপ ছোঁবল

    চাইছো সবার হোক ভাল

    তোমার সুমধুর কণ্ঠ যখন নদীর সঙ্গীত

    বাতাসের কাণে বাজে এ কোণ আশংকার বিউগল ?

    অতটা উদারতায় যেও না; থামো. ..

    দেবালয়ের সেবককে স্থানচূ্্যত করলেই

    দেবোত্তর সম্পত্তির হবে কড়ি কড়ি ভাগাভাগি

    ফ্রেশ রুমের কমোডেও লুকিয়ে থাকতে পারে সাপ

    সাবধানে ফেলতে হবে চরণ যুগল
    চাই না জাতির আর কোনো গোল্লাছুট !

    ReplyDelete